গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে নাটোরের বনলতা সেন লিখেছেন তা কে? আপনি কি সত্যিই এই নামে কাউকে চেনেন?’ উত্তরে কবি শুধু একটা মুচকি হাসি দিলেন। কবি নিজের অজান্তেই এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেননি। কবি নীরব থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই বনলতা সেনকে খুঁজছেন গবেষকরা। কিন্তু ফলাফল সবসময়ই শূন্য। বাস্তবে তারা এমন কোনো বনলতা সেনের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।
বাংলা সাহিত্যে নাটোরের বিখ্যাত হয়ে ওঠা
নাটোরের একটি জনপ্রিয় গল্পে দেখা যায় যে একবার দার্জিলিং যাওয়ার ট্রেনটি নাটোরের উপর দিয়ে যেতে হয়েছিল। জীবনানন্দ দাস একদিন ট্রেনে করে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। ট্রেন নাটোর স্টেশনে পৌঁছালে একটি সুন্দরী মেয়ে ট্রেনে ওঠে। মেয়েটির সাথে ভুবন সেন নামে এক বৃদ্ধও ছিলেন। তারা কবি যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরে উঠে গেল। রুমে শুধু এই তিনজন ছিল। ভুবন সেন নাটোরের বনেদি সুকুল পরিবারের তারাপদ সুকুলের ব্যবস্থাপক ছিলেন। সেই সুন্দরী মেয়েটি ছিল ভুবন সেনের বিধবা বোন ‘বনলতা সেন’। একবার ভুবন সেন ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় বনলতা সেনের সঙ্গে কবির কথোপকথন কেন্দ্রীভূত হয়। এভাবে কথা বলে অনেকটা সময় কেটেছে তাদের। একবার ট্রেন থেকে নামলেন ‘বনলতা সেন’। কবি আবার একা হয়ে গেলেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি লাইন এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তা হল- ‘বনলতা সেন শুধু অন্ধকারের দিকে মুখ করে বসে আছেন’।
স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে আরও অনেক কাহিনী
অন্য গল্পেও ভুবন সেনের উল্লেখ আছে। এখানে ‘বনলতা সেন’ ভুবন সেনের বিধবা বোন এবং দৃশ্যের ট্রেনের পরিবর্তে ভুবন সেনের বাড়ি উল্লেখ করা হয়েছে এবং নাটোরের বনেদি পরিবার সুকুল বাবুর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। একদিন কবি নাটো পরিদর্শনে গেলেন। তিনি নাটোরে গিয়ে সুকুল বাবুর বাড়িতে থাকেন। একদিন বিকেলে ভুবন সেন কবিকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। ভুবন সেনের বিধবা বোন ‘বনলতা সেন’কে কবির মনোরঞ্জনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতাও দ্বিতীয় গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে দৃশ্যটি ট্রেনের নয়, ভুবন সেনের বাড়ির। জীবনানন্দ নাটোরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সুকুলবাবুর বাড়িতে অতিথি হয়ে ওঠে নাটোরের বনেদি পরিবার। একদিন বিকেলে সুকুল এস্টেটের ম্যানেজার ভুবন সেনের বাড়িতে আমন্ত্রণ। অতিথিদের আপ্যায়ন করার দায়িত্ব ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতা সেনের ওপর। কবি বসে আছেন খাবারের খাটে। হঠাৎ অঘোষিত এক বিধবা মেয়ে। সাদা পোশাকের চেয়ে সুন্দর মুখই বেশি সুন্দর। কবি অবাক হলেন। এত অল্প বয়সে বৈধব্য কবির মনকে নাড়া দেয়। সে সময় হয়তো বনলতার কবির সঙ্গে দু-একটা কথা ছিল। তারপর একসময় কবি নাটোর চলে যান। আপনার সাথে একটি বিস্ময়কর মুখের ছবি নিন। সেই ছবিই হয়তো কবিকে পথ দেখিয়েছিল অন্ধকারে, খুঁজেছে শান্তির সাগরে।
নাটোরে একটি চূড়ান্ত ও তৃতীয় গল্প প্রচলিত আছে। তবে এবার দৃশ্যপট নাটোর রাজবাড়ীর। এক সময় কবি জীবনানন্দ দাশ নাটোরের জনৈক রাজার আমন্ত্রণে প্রাসাদ পরিদর্শনে আসেন। রাজা কবির দেখাশোনার জন্য কয়েকজন সুন্দরী নারীকে নিযুক্ত করলেন। তাদের মধ্যে একজন সুন্দরীর প্রতি কবির বিশেষ সহানুভূতি জন্মে। কবি সুন্দরীকে নিয়ে কবিতা লিখতে বললে সুন্দরী রাজি হননি। শেষে কবির পীড়াপীড়িতে তিনি কবিকে অন্য নামে কবিতাটি লেখার অনুরোধ করেন। তাই সেই সুন্দরীর আসল নাম লুকিয়ে ‘বনলতা সেন’ নামটি উল্লেখ করেছেন তিনি।
যতক্ষণ গল্প আছে। বাস্তব ও ইতিহাসে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। বাঘা বাঘা সব গবেষকরা বছরের পর বছর গবেষণা করেও এই ‘বনলতা সেন’-এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। পৃথিবীর আর দশটা রহস্যের মতো এটাও একটা অজানা রহস্য রয়ে গেছে।